preloader bangali.network
লোড হচ্ছে ...
মেনু
Glocal বাঙালি | Vocal বাঙালি
পঞ্চু তারপর আমার খুব বন্ধু হয়ে যায়

লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন… শব্দ তিনটির সঙ্গে পরিচয় আমার অনেকদিনের। আমার নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে থাকা শব্দটির হাত ধরেই, আবিষ্কার করেছিলাম আমার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অভিনেত্রীকে। মায়ের প্রেরণায়, বাড়ির সকলের সহমতে, খুব ছোট বয়সে মুখে রং মেখে মানুষের মনোরঞ্জনের কাজে মেতে উঠি। আমার শিল্পী মন আনন্দে ভরে যেত প্রতিদিন। বহু মানুষের ভালোবাসায়, প্রশংসায়, বহু গুণী মানুষের উৎসাহে, আরো অনেক ভালো কাজের খিদেটা বেড়েই চলছিল। আমার ইচ্ছা পূরণ করতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাঁর আশীর্বাদস্বরূপ আমার ঝুলিতে ভরে চলেছিলেন অনেক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত, অনেক ভালো কাজ। সেই রকমই একটি অভিজ্ঞতা, আজ আমি ভাগ করে নিতে চাইছি আপনাদের সঙ্গে।

তখন আমি ক্লাস ফোর। ল্যান্ড লাইনে ফোন আসে একটা প্রজেক্টের। অ্যানুয়াল পরীক্ষা সামনে বলে আমি তখন সেভাবে কাজ করছিলাম না। স্কুল শিক্ষক বাবার কড়া হুকুম মানতে। তবে যিনি ফোন করেছিলেন, তাঁর গলা শুনে এবং তাঁর আর্জি শুনেই বোধহয় নাকচ করাটা মায়ের সাহসে কুলোয়নি।

ফোনটা করেছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। ওঁর লেখা 'পান্ডব গোয়েন্দা'-কে নিয়ে মেগাসিরিয়াল হবে। ‘তারা বাংলা’-য় (তখনকার নামকরা টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে অন্যতম) সম্প্রচারিত হবে। তাতে আমাকে বিচ্ছুর ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। ছোট থেকেই গোয়েন্দা গল্পের খুব ভক্ত আমি। আর পান্ডব গোয়েন্দা তো বাঙালির ঐতিহ্য। আমি তো একপায়ে খাড়া। বাবাও দেখলাম কোনো আপত্তি জানালেন না।

আমার মনে আছে শুটিং শুরু হওয়ার আগের দিন রাতে ফোন করে আমাদের পরিচালক বলেছিলেন, ‘চরিত্রটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়, অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনার সাক্ষী হতে হবে তোমায়’।

শুটিংয়ের জন্য আমরা পাড়ি দিলাম ডায়মন্ডহারবার। প্রথমে ১৫ দিনের আউটডোর। গল্প অনুযায়ী বাবলু, ভোম্বল, বিলু, বাচ্চু আর বিচ্ছু ছাড়াও দলে আরো একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল। এত ভালো একটা চরিত্র পাওয়ার আনন্দে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম ‘পঞ্চু’-র কথা। এবং সঙ্গে এটাও ভুলে গিয়েছিলাম যে কুকুরে আমার কী মারাত্মক ভয়। মা-বাবাও প্রথম দিন ওই জন্য কিছু বলেনি।

শুটিংয়ের প্রথম দিনে আমরা পাঁচজন আড্ডা মারছি, এমন একটা সিন আছে। পরিচালক, সহ-পরিচালক বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। আমরা রেডি সবাই। হঠাৎ পঞ্চুকে আনা হল।

আসল গল্পে পঞ্চু একটি দেশি কুকুর। কিন্তু আমাদের কাজের সুবিধার্থে, একটি ট্রেনিংপ্রাপ্ত জার্মান শেফার্ড নেওয়া হয়েছিল।

'নামে কী আসে যায়?' আমি তো ওর চেহারা দেখেই অজ্ঞান হয়ে যাই প্রায়। এদিকে চরিত্রের প্রয়োজন অনুযায়ী আমাকে মানে, বিচ্ছুকে পঞ্চুর সাথে লেপ্টে থাকতে হবে। আমি তো পালাবার পথ পাচ্ছি না। ভয়ে সিঁটিয়ে আছি। দলের অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তারা দিব্যি "আয় আয়, নে নে" করে ভাব জমিয়েছে।

আমি বারবার সংলাপ ভুলছিলাম। যেটা আমার কখনোই হয় না। পরিচালক বুঝতে পেরে, পঞ্চুকে এক জায়গায় বেঁধে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার প্রাণপাখি ফিরে এল দেহে।

প্রথম সিনের পর পরিচালক কাছে ডাকলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই হবে। চরিত্র না হলে ঝুলে যাবে। মায়ের কাছে খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। আমার জন্য একটা গোটা প্রজেক্ট ঝুলে যেতে পারে না। আমি তখন অনেক ছোট, তাই হয়তো অপরাধবোধটাও চরম ছিল।

যাইহোক পরের দিন শুটিংয়ে আমরা সবাই সিন পড়ছি। বাদশা (পঞ্চুর আসল নাম), দূরে দাঁড়িয়ে ওর মনিবের সঙ্গে ঢুলছে। হঠাৎ গ্রামের রাস্তায় ঠেলাগাড়ি নিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করতে দেখে আমরা সকলেই বায়না জুড়ি, আইসক্রিম খাব। বায়না রাখতে প্রোডাকশন ম্যানেজার, আমাদের চারজনকে কাঠি আইসক্রিম কিনে দেন। বাবলুদা একটু বড় আমাদের থেকে। ও বাদশার কাছে বসে আইসক্রিমটা খাচ্ছিল। হঠাৎ বাদশার নজর পড়তেই, বাবলুদার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় আইসক্রিম। কামড় বসায়। রক্তারক্তি কাণ্ড। আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। সিন করব কী? রানিং ক্যামেরায় আমার নজর সব সময় পঞ্চুর দিকে। এক্সপ্রেশন, অ্যাক্টিং সবই খারাপ হচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম।

সেইদিন রাতে আমার একার সিন। একটা বালতি খুঁজতে যাওয়ার। অন্ধকারে, জঙ্গলে। সঙ্গে পঞ্চু। আমাকে রিহার্সাল পর্যন্ত কেউ বলেনি যে, পঞ্চুও আছে সিনে। যাতে আমি ভয় না পাই। অন দ্য শট, ওকে ছাড়া হবে। অন্ধকার ঘুটঘুটে জঙ্গল। সাপের আস্তানা। আমার মা খুব ভয় পাচ্ছিলেন। সেদিন যদিও সিনের প্রয়োজন অনুযায়ী লাইট ছিল। তাও ওই ঘন অন্ধকারকে টেক্কা দিতে পারছিল না।

আমি পরিচালকের কথামতো সিনে ব্যস্ত। খোঁজার অভিনয় করছি। হঠাৎ সবাই "রে রে রে রে" করে চেঁচিয়ে উঠল। আমি ভয় পেয়ে পেছনে ঘুরতেই দেখলাম, একটা বিশাল বড় সাপ ফণা তুলেছে আমার দিকে। মা চিৎকার করে উঠলেন, "আমার মেয়েটা গেল"। আমি তো প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাই আর কী ! টিম মেম্বাররা কিছু করার আগেই দেখলাম, পঞ্চু ঝাঁপাল। ওর বিশাল শরীর নিয়ে। সাপটাকে কামড়ে কামড়ে ঘায়েল করে ফেলল। ততক্ষণে আমাকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আর পঞ্চুকেও ছাড়ানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সাপটা আধমরা তখন, পঞ্চুও ঘায়েল হয়েছে। সাপটা পালাতেই, পঞ্চুকে ওর মনিব নিয়ে চলে গেল। ফার্স্ট এড-এর ব্যবস্থা করতে। আমি ভয় কাটিয়ে উঠে, পঞ্চুর খোঁজ করতে লাগলাম।

দেখলাম জঙ্গলের এক কোণে দাঁড়িয়ে পঞ্চু কুঁইকুঁই করছে। জানি না আমার কী হল, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। ও আমাকে কিচ্ছু বলল না। চেটে চেটে আদর দিল শুধু। সেদিনের ঐ সরল দৃষ্টিতে ও আমাকে কী বুঝিয়েছিল জানি না, তবে তারপর থেকে আমার সিন করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। প্রত্যেকটা সিনেই পঞ্চু আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে থাকত।

বিভিন্ন কারণে সিরিয়ালটি খুব তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমার মনের মণিকোঠায় সেই দিনগুলো স্বর্ণাক্ষরে খচিত থাকবে। এই অভিজ্ঞতা বহুদিন পর ‘বাঙালি নেটওয়ার্ক’-এর পাতায় লিখতে পেরে বড় ভালো লাগল।




লেখক পরিচিতি

ভালো লাগলে ভালোবাসা দিন ।
অপছন্দ হলে পরামর্শ দিন ।
Rate করুন । Comment করুন ।
এই আর্টিকেলের রেটিং
4 1 ভোট
স্টার
সাবস্ক্রাইব
অবহিত হন
guest
0 কমেন্ট
ইনলাইন প্রতিক্রিয়া
সকল মন্তব্য দেখুন
icons bangali.network contact

Scroll to Top