যত দিন যাচ্ছে যেভাবে চারদিক বদলাচ্ছে তার ছাপ পড়ছে আমাদের মনের উপর। এই ছাপ নিশ্চয় অনেক ক্ষেত্রেই ভালো, আবার মনের উপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়াও কম পড়ছে না। বিশেষত আজকের এই দ্রুতগামী জীবনে আশা ও প্রত্যাশার যে বিশাল চাপ আমাদের তরুণরা বহন করে চলেছে, সব সময় তা সহ্য করে নেওয়া সম্ভব হয় না। এরকমই একটি খবর দেখছিলাম কাগজে। কেরালার আলাপ্পুঝায় এপ্রিল ফুল করতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে একটি সতেরো বছরের ছেলের। কিলিরুরের একটি ভাড়াবাড়িতে বসে সে নাকি মোবাইল স্ট্রিমিং মোডে নিয়ে গিয়ে বন্ধুদের ভড়কে দেবার জন্যে আত্মহত্যার অভিনয় করে দেখাচ্ছিল।
আসলে বয়ঃসন্ধি সময়টা সকলের জীবনেই খুব ডেলিকেট আর স্পর্শকাতর একটা সময়, যখন মনের মধ্যে অনেক রকম তোলপাড়, ভাঙাগড়া হয়। এই বয়েসে পারিপার্শ্বিক সাপোর্ট সব থেকে বেশি দরকার হয়। দরকার হয় ওদের মনের চাহিদাটাকে ভালো করে বোঝার। অথচ সাধারণত আমরা, বড়রা এই ক্ষেত্রে যেটা করি সেটা হল ওদের বোঝানোর চেষ্টা। ওদের চাওয়া বলুন , পাওয়া-না পাওয়া বলুন, সুবিধা অসুবিধা বলুন সব ক্ষেত্রেই তাদের পাশে থাকার দরকার হয়। বুঝিয়ে এই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়, যদি না নিজেরাই তাদের মনকে বুঝি। কেননা বুঝলেই একমাত্র আমরা তাদের বন্ধু হতে পারব। আর বন্ধুই যদি না হতে পারলাম, তাহলে তাদের বোঝানো কি অত সহজ?
বয়ঃসন্ধিতে মানুষ সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয় তাদের বন্ধুদের দ্বারা। আমাদের পরিভাষায় এটা হল পিয়ার গ্রুপ। মনে রাখতে হবে, এই বয়েসে ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই গ্রুপ ফিলিংটাই বেশি কাজ করে। যেসব কথা তারা অভিভাবক, শিক্ষক কাউকেই বলতে পারে না তা তারা শেয়ার করে বন্ধুদের সঙ্গে। আর এই জন্যেই যেটা এমনিতে বোঝানোই যাচ্ছে না সেটা বন্ধুরা সহজেই বুঝিয়ে দিতে পারে। এই সময়ে তারা চায় না কেউ তাদের শাসন করুক। কারণ তারা এখন আর ছোট নেই। শৈশব পেছনে ফেলে তার এখন এগিয়ে যাচ্ছে যৌবনের দিকে। এই সময়ে নানা নিষিদ্ধের আকর্ষণ প্রবল হয় স্রেফ অভিভাবকদের শাসনকে অস্বীকার করার জন্যেই। কিন্তু স্বাধীনতার সঙ্গে যে দায়িত্ব বোধ অর্জন করতে হয় তার বোধ তাদের মধ্যে শিকড় গাড়তে পারেনি। এই জন্যেই বলছি, এখন ওরা কনফিউজড থাকে। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন হয় সঠিক পরামর্শ। কিন্তু পরামর্শ দিতে গিয়ে আমরা অধিকাংশ সময় নির্দেশ দিয়ে ফেলি, তাদের বড় হতে থাকা সত্ত্বাটাকে অস্বীকার করে ফেলি। তার সঙ্গে মিশে থাকে আমাদের অহং বোধ।
দেখবেন, এই প্রজন্মের বিষয়ে কথা উঠলেই একটা কথা বেশি উঠে আসে, যে এদের নাকি ধৈর্য একদম নেই। ছোটখাটো অসুবিধে, সামান্য না পাওয়াই হয়ত তাদের বিচলিত করে। তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে তৈরি থাকে না তারা। এখান থেকে আসতেই পারে আত্মহত্যার প্রবণতাও।
মনে রাখতে হবে এই বয়েসের ছেলেমেয়েদের কাছে এক্সপোজার জিনিসটা আজ অনেক দ্রুত পৌঁছয়। ফলে নানা খবরও তারা সহজেই পেয়ে যায়। কোনো একজনও যদি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তাহলে আরো অনেকের কাছেই ‘আরে এটাও তো পথ হতে পারে’ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তারা বোঝে না এই পথ থেকে ফেরার আর উপায় থাকে না। মানে, এই পথের শেষে যে কম্পিউটরের আন-ডু বাটনটা নেই, এটা তাদের মাথায় থাকে না।
এই সঙ্গে বলার, এই প্রজন্ম কিন্তু অনেক কিছু পেতে পেতে বড় হয়েছে। ফলে এদের পাওয়ার (এবং Power-ও বটে) বোধটা খুব তীব্র। ‘না’ শুনতে এরা অভ্যস্ত নয়। সেই সঙ্গে এই একুশ শতকের ইঁদুর দৌড়ের মারাত্মক চাপও এদের নিতে হয়। আমরা অনেকেই বলি, ‘আরে বাবা, এই বয়েসে আমাদেরকেও অনেক বকা খেয়েছি, মারও খেয়েছি, কিন্তু এইভাবে তো...’ এটা বলার সময়ে আমরা লক্ষ্য করুন কনভেনিয়েন্টলি ভুলে বসে আছি যে সমাজ, বাবা-মা সক্কলের কাছ থেকে এরকম মারাত্মক ‘চাহিদা’-র চাপ কিন্তু আমাদের নিতে হয়নি। ফলে তুলনা টানাটা খুব যুক্তিযুক্ত হচ্ছে? তার থেকে ভালো না বন্ধুর মতো ওদের পাশে থেকে, ওদের সঙ্গে হাতেহাত মিলিয়ে বিষয়টাকে ট্যাকল করা? চাণক্যের সেই উপদেশ মনে করুন – প্রাপ্তে তু ষোড়শ বর্ষে পুত্রমিত্রবদাচরেত।

বেল ভিউ ক্লিনিক, ক্রিস্টাল মাইন্ডস এবং অন্যত্র কন্সাল্টিং সাইকোলজিস্ট, আই সি এ আই এবং আরো বহু সংস্থার ফ্যাকাল্টি ডা. সুবর্ণা সেন নলেজ কর্প সহ আরো বহু সংস্থার সঙ্গে ট্রেইনার হিসাবেও জড়িত।