preloader bangali.network
লোড হচ্ছে ...
মেনু
Glocal বাঙালি | Vocal বাঙালি
ভারতের প্রথম লাভজনক কয়লা শিল্প গড়ে তোলা এক বাঙালির গল্প

১৮৫৩ সালের ১৬ই এপ্রিল, সকাল ৩টে ৩৫ মিনিট। বোম্বে শহরের বোরিবন্দর স্টেশন (বর্তমানে মুম্বাই-এর ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস) থেকে একটি ট্রেন প্রায় ৪০০ যাত্রীকে নিয়ে থানের উদ্যেশ্যে রওয়ানা হলো। আর তার সাথেই সূচনা হলো ভারতীয় উপমহাদেশে যাত্রীবাহী রেল পরিবহণের। ট্রেন চলাচল যদিও ১৯৩৭ সাল থেকে মাড্রাস (বর্তমানে চেন্নাই)-এ শুরু হয়ে গেছিল, কিন্তু সেটা যাত্রী নয়, গ্রানাইট পরিবহন করার জন্য।

‘সুলতান’, ‘সিন্ধ’, আর ‘সাহিব’ নামের তিনটি ইঞ্জিনে টানা, ১৪ বগির যাত্রীবাহী ট্রেনটি ৫৭ মিনিটে ৩৪ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে থানে পৌঁছায়। এর পরে ভারতবর্ষে রেলের বিস্তার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকোমোটিভের জন্য কয়লার চাহিদাও দ্রুত বাড়তে থাকে। আর ব্যবসা বাড়তে থাকে ভারতের কয়লা শিল্পের অগ্রদূত সংস্থাটির – ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’র।

‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’ ছিল ব্রিটিশ ভারতে প্রতিষ্ঠিত অন্যতম প্রাচীন এবং প্রভাবশালী কোল মাইনিং সংস্থা, ভারতীয় শিল্পায়নের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা দেশের কয়লা শিল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। পাশাপাশি লোহা, স্টিম, টেক্সটাইল ইত্যাদির মতো অন্যান্য শিল্পের জন্য জ্বালানির যোগান দিয়ে দেশের শিল্প ভিত্তি শক্তিশালী করে। এছাড়া, খনিশহর যেমন আসানসোল ও দুর্গাপুরের আর্বানাইজেশন-ও এই সংস্থার কার্যক্রমেই শুরু হয়।

আনুষ্ঠানিকভাবে ১৮৪৩ সালে গঠিত হলেও, ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’র সূচনা হয়েছিল আরও আগে ভারতের অন্যতম প্রথম একজন আধুনিক মনস্ক শিল্পপতির দ্বারা, যিনি কয়লার ভবিষ্যৎ গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৮৩২ সালে, রাণীগঞ্জে ভারতের প্রাচীনতম, বৃহত্তম এবং ধনীতম কয়লা খনিটি কিনেছিলেন। ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে তিনি যৌথভাবে গঠন করেন ‘ক্যার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’, যা বিশাল সাফল্যের সাথে ব্যবসা করতে থাকে। এখানে উল্লেখযোগ্য, রানীগঞ্জ কয়লাখনির পূর্ববর্তী দুই ব্রিটিশ মালিকই লাভজনক ভাবে ব্যবসা চালাতে অক্ষম হয়েছিলেন।

‘ক্যার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ পরবর্তীকালে তাদের প্রধান প্রতিযোগি ‘গিলমোর হোমব্রে অ্যান্ড কোম্পানি’র কয়লা খনিকে কিনে নেয় এবং ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করে। কয়লার ক্ষেত্রে তাদের প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা নিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ খুশি ছিল না। কিন্তু কোম্পানিকে ভাঙার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। বেঙ্গল কোল কোম্পানির কয়লা বাংলা তথা ভারতের শিল্প বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ভারতে অর্গানাইজড কোল মাইনিং-এর সূচনাও এখান থেকেই হয়।

বার বার ‘টেগোর’ নামটা শুনে কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা মনে পরে গেল?

মনে পড়লে কিন্তু কোন ভুল হবে না। কারণ যে দূরদর্শী শিল্পপতির উল্লেখ করা হয়েছে তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই ঠাকুরদা ‘প্রিন্স’ দ্বারকানাথ ঠাকুর।

‘প্রিন্স’ দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন উনবিংশ শতকের বাংলা তথা ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, ব্যবসার জগতে একজন পথিকৃৎ। তাঁর ‘ক্যার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ একজন ভারতীয় ও একজন ইউরোপিয়ানের মধ্যে ৫০-৫০ পার্টনারশীপ-এ গড়ে ওঠা প্রথম ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। নীল ব্যবসার ক্ষেত্রে ‘ক্যার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ খুব তাড়াতাড়ি মার্কেট লিডার হয়ে ওঠে। সে'সময় বিশ্ব বাণিজ্যের কারেন্সী ছিল আফিম। কিন্তু আফিমের ব্যবসা করার লাইসেন্স ইউরোপীয়রা ছাড়া কেবলমাত্র পার্সিরা পেত। দ্বারকানাথ একজন মিড্ লেভেল সাব-এজেন্ট হয়ে আফিম ব্যবসায় ঢোকেন এবং অল্প সময়েই প্রচুর লাভ করেন। সেই লাভ কে পুঁজি করে ‘ক্যার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ কয়লা ব্যবসা শুরু করে। তারপর একে একে ব্যাঙ্কিং, শিপিং, ইন্সুরেন্স, চা-বাগান , এবং পাট শিল্পে বিনিয়োগ করে।

দ্বারকানাথ ১৮২৮ সালে প্রথম ভারতীয় ব্যাংক ডিরেক্টর হন। এর পরের বছর তিনি কলকাতায় ইউনিয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। শীঘ্রই যাত্রী ও পণ্য পরিবহনকে সহজ করতে গঙ্গায় একটি স্টিমবোট ফেরি পরিষেবা গড়ে তোলেন। এরপর কলকাতায় একটি মডার্ন শিপইয়ার্ড তৈরী করেন যেখানে যাত্রীবাহী ও বাণিজ্যিক জাহাজ নির্মাণ শুরু হয়। তাঁর নেতৃত্বে 'ক্যার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ জাহাজ নির্মাণ ও বাণিজ্যে, বিশেষ করে চীন-এর সাথে বাণিজ্যে, প্রধান খেলোয়াড় হয়ে ওঠে।

কিংবদন্তি আছে, কুইন ভিক্টোরিয়া একবার একটি জলসার আয়োজন করেন। সমাজের হোমরা চোমরা ব্যক্তিরা সব নিমন্ত্রণ পেলেন, রয়েল সব গেস্টরা আসলেন। কুইনের সম্মানে সবাই পড়লেন তাঁদের সবচেয়ে দামি পোশাক। সোনা রুপোর কারুকাজ করা, হীরে মোতি বসানো। দ্বারকানাথও পেলেন ইনভিটেশন। পরলেন কারুকাজহীন সাদা সুতির পোশাক। পায়ে দিলেন শুঁড় তোলা নাগরা। প্রতি শুঁড়ে ঝুলছে প্রকান্ড মার্বেল এর আয়তনের একটি করে হীরে। তিনি জানতেন রীতি অনুসারে সব অতিথিকেই জুতোজোড়া বাইরে খুলে ঢুকতে হবে। নিস্পৃহ ভাবে সেই হীরকখচিত জুতো বাইরে খুলে হলের ভেতরে ঢুকে গেলেন। ভেতরে জাঁকজমকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সত্যিকারের রাজপুত্ররা, কিন্তু সাদা পোশাক পড়া এক ভারতীয় সেদিন হয়ে গেলেন 'প্রিন্স’।

কলকাতা থেকে রাণীগঞ্জ পর্যন্ত একটি রেলপথ নির্মাণের লক্ষ্যে দ্বারকানাথ ১৮৪৫ সালে 'গ্রেট ওয়েস্টার্ন অফ বেঙ্গল রেলওয়ে' নামের একটি কোম্পানি রেজিস্টার করেন এবং ‘ক্যার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি'কে এজেন্ট নিযুক্ত করেন। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির সাথে একটি চুক্তি করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু রেলপথ 'নেটিভ'দের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার অনুমতি দিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্পষ্টভাবে অস্বীকৃতি জানায়।

১০ বছর পর দ্বারকানাথের কল্পনার সেই রেলপথ দিয়েই ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কোম্পানির মালগাড়ি রাণীগঞ্জে প্রবেশ করে এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘বেঙ্গল কোল কোম্পানি’র কয়লা কলকাতায় বয়ে আনে। দুঃখের বিষয়, দ্বারকানাথ সেটা দেখে যেতে পারেন নি। কিন্তু ভারতের ব্যবসার ইতিহাসে এটি ছিল একটি অন্যতম অধ্যায়। রানিগঞ্জে তাঁর কয়লা খনির উদ্যোগ ভারতে শিল্পায়নের পথ সুগম করে।

তবে তাঁর অবদান কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যর প্রতিপত্তিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন একজন ভিশনারি, একজন সোশ্যাল রিফর্মার। বাংলার নবজাগরণে তাঁর অসামান্য অবদান ভবিষ্যতের সোশ্যাল এবং ইন্টেলেক্চুয়াল রিফরমেশন-এর ভিত্তি স্থাপন করে। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার এক সমৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেওয়া দ্বারকানাথ ঠাকুরকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তে পাঠানো হয়। সেখানে তাঁর ফিলোসফি ও সাইন্স-এর সাথে সাথে উদারনৈতিক চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচয় হয়। রাজা রামমোহন রায়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে তিনি সতীপ্রথা উচ্ছেদ, বাল্যবিবাহের বিরোধিতা, বিধবা বিবাহের সমর্থন ও নারী শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি স্কুল ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং দেশে মডার্ন মেডিসিন, ভ্যাকসিন, ট্রিটমেন্ট প্রভৃতির পরিকাঠামো গড়ে তোলার প্রবল সমর্থক ছিলেন, এবং তার জন্য নিয়মিত ডোনেশন দিতেন।

আধুনিক চালচলনের কারণে রাজা রামমোহনের মতো তিনিও ছিলেন কট্টরপন্থীদের দুচোখের বিষ। দুর্ভাগ্য বসত, একই কারণে স্ত্রী দিগম্বরী দেবীর সাথেও তাঁর বিবাহিত জীবনে টানাপোড়েন দেখা দেয়। তাঁর স্ত্রী কট্টরপন্থী হিন্দু ব্রাহ্মণদের পরামর্শে স্বামীর সাথে স্বাভাবিক দম্পতির মতো সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নেন। কখনো কোনো পারিবারিক বিষয়ে কথা বলতে বাধ্য হলে আলোচনার ঠিক পরেই দিগম্বরী দেবী ‘পাপমুক্ত’ হতে গঙ্গাস্নান করতেন। ১৮৩৯ সালে এক শীতের রাতে এমনই এক গঙ্গাস্নানের পর তিনি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হন, আর সেই জ্বর তাঁর কাল হয়। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে দিগম্বরী দেবী প্রাণ হারান।

এর মাত্র ৭ বছর পরে ৫১ বছর বয়েসে, লন্ডনের সেন্ট জর্জ হোটেলে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা অগাস্ট দ্বারকানাথের মৃত্যু হয়। ৭ই অগাস্ট 'লন্ডন মেইল' পত্রিকা লিখেছিল –
“ভারতের সর্বোচ্চ ব্রাহ্মণ বর্ণ থেকে আসা সম্ভ্রান্ত মানুষটির জীবন তাঁর আভিজাত্য ও বংশ মর্যাদার কারণে নয়, বরং একটি বৃহত্তর কারণে আলোচিত হচ্ছে। প্রতিভা ও সম্পদের অনেক ওপরে তাঁর অন্য একটি স্বত্ব – তিনি ছিলেন তাঁর দেশের হিতৈষী... তাঁর প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ তাঁর যোগ্যতার সাক্ষ্য দেয়, যা সম্ভবত ভারতের উপকার করবে।"




লেখক পরিচিতি

ভালো লাগলে ভালোবাসা দিন ।
অপছন্দ হলে পরামর্শ দিন ।
Rate করুন । Comment করুন ।
এই আর্টিকেলের রেটিং
4 1 ভোট
স্টার
সাবস্ক্রাইব
নোটিফিকেশন পান
guest
0 কমেন্ট
নতুন থেকে পুরোনো
পুরোনো থেকে নতুন ভোটপ্রাপ্তি অনুসারে
ইনলাইন প্রতিক্রিয়া
সকল মন্তব্য দেখুন
icons bangali.network contact

Scroll to Top